সবুজ বনের সৌন্দর্য্যের হাতছানি

বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমির নাম হলো সুন্দরবন। যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলীর অন্যতম। সুন্দরবন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা লবণাক্ত বনাঞ্চল। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা যৌথভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। এ বনের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর শোভামন্ডিত দর্শনীয় স্থানগুলোতে পাখির কলকাকলি, হরিণের বিচরণ, বানরের দুষ্টমী, বিশুদ্ধ বাতাস হাতছানি দেয় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের।

সুন্দরী গাছ থেকে সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে, যা এ বনে প্রচুর জন্মায়। রাত-দিনে ছয়বার রূপ বদলায় এ বন। যার সকালে এক রূপ, দুপুরে অন্যরূপ আর পড়ন্ত বিকালে নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়। রাতে গহিন বনের মধ্যে এক ভিন্ন রূপ তৈরি করে সুন্দরবন। অমাবস্যায় কিংবা চাঁদনি রাতে নানান রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয় সুন্দরবন।

চোখ জুড়ানো, শিহরন জাগানো সুন্দরবনে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় হরেক রঙ্গের পাখ পাখালি। দল ধরে ঘুরে বেড়ায় মায়াবী হরিণের পাল, বন্য শুকর। এক গাছ থেকে অন্য গাছে বানরের ছুটাছুটি। ফুট ট্রেইল ধরে বনের ভেতরে এগুতে দুই ধারে ঘন জঙ্গল। দক্ষিণাঞ্চলের রক্ষাকবচও সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে নদী, খাল ও সমুদ্র আর রহস্যঘেরা বনভূমি। বনের মায়াবী রূপের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য মুগ্ধতা ছড়ায়, শিহরন জাগায় প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে। যার কারণে প্রতিবছর দল ধরে দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন এ বনে।

নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে নদী ও সমুদ্র শান্ত থাকায় সুন্দরবন ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। এ সময় সুন্দরবনের প্রায় সব দর্শনীয় জায়গা ঘুরে দেখা যায়। খুলনা ও মোংলা থেকে সবচেয়ে কাছে করমজল ও হারবাড়িয়া বছরের যেকোনো সময় এক দিনেই ঘুরে দেখা যায়। তবে মূল সুন্দরবনের স্বাদ পেতে হলে তিন দিনের ভ্রমণে বনের গহিনে যেতে হবে।

সুন্দরবন বিশাল একটি অঞ্চল। বন বিভাগ থেকে এ বনের নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গা ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়। পর্যটক ও দর্শনার্থীরা সাধারণত এ বনের করমজল, হারবাড়িয়া, কচিখালি, কটকা, ডিমের চর, জামতলা সি বীচ, হিরণ পয়েন্ট, আন্দারমানিক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র ও দুবলার চর ভ্রমন করেন।

নিরাপত্তা, অনুমতি, খরচ আর জটিল প্রক্রিয়ার কারণে সুন্দরবনের গহিনে ভ্রমণের সবচেয়ে সহজ ও সাশ্রয়ী উপায় হচ্ছে কোনো ট্যুর অপারেটরের সঙ্গে যাওয়া। নির্ধারিত প্যাকেজের মধ্যে লঞ্চ বা জাহাজে ওঠার পর থেকে ট্যুর শেষ করে ঘাটে ফেরা পর্যন্ত থাকার ব্যবস্থা, তিন বেলার খাবার, দুই বেলা হালকা নাশতা, বন বিভাগের অনুমতি, নিরাপত্তারক্ষী ও গাইডসহ যাবতীয় খরচ প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত থাকে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের অংশ ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ, দীর্ঘতম লবণাক্ত জলাভূমি এবং জীব বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইকোসিস্টেম। এখানে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিদ্যমান, যার মধ্যে আছে ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং বিশ্ব বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। প্রধান সরীসৃপ জাতিগুলোর মধ্যে আছে নোনা পানির কুমির, অজগর, গোখরা, গুইসাপ, সামুদ্রিক সাপ, গিরগিটি, কচ্ছপ এবং অন্যান্য। প্রায় ৩০ প্রজাতির সাপ সুন্দরবনে পাওয়া যায়। জলাভূমি হিসাবে রামসার এলাকার সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকায় সুন্দরবনকে ১৯৯২ সালে ৫৬০ তম রামসার এলাকা হিসাবে যোষণা করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে।

ময়মনসিংহ থেকে স্ত্রী নিয়ে সুন্দরবনে ঘুরতে আসা কায়সার আহমেদ বলেন, যতটা সুন্দর শুনেছি তার চেয়ে বেশি সুন্দর এ বন। বিশুদ্ধ বাতাস বনের মধ্যদিয়ে হেঁটে চলার সব ক্রান্তি দূর করে দিয়েছে।

তার স্ত্রী বলেন, মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সুন্দরবনের কোনো জুড়ি নেই। এ মায়ায় বার বার এ বনে আসতে মন চাইবে।

সুন্দরবন দেখতে আসা শিশু নাইম দুঃখ করে বলে, বনে আসলাম বাঘ দেখতে কিন্তু সেই বাঘের দেখা পেলাম না।

রাফা নামের এক কলেজ শিক্ষর্থী বলেন, যে বনের নাম সুন্দরবন সে যে সুন্দর হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এ বনযে এতটা মায়াবী তা আগে জানা ছিল না। এ বনের জামতলা সমুদ্র সৈকত সকালের সূর্য উদয় দেখতে আমার খুব ভালো লেগেছে।

আমেরিকান নাগরিক মেরি বলেন, সুন্দরবনে না আসলে বাংলাদেশ ভ্রমণ বৃথা যেতো। এ বনের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

স্পেনের নাগরিক হোসাইন বলেন, এক কথায় অসাধারণ বন এটি।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন কর্মকর্তা (এসিএফ) দ্বীপন চন্দ্র দাস বলেন, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বিমুগ্ধ হওয়ার মতো। যে কারণে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি পর্যটক ভিড় করেন এ বনে। এ বনের ডিমের চর কচিখালী অভয়ারণ্যের আওতাধীন একটি চর। পাখির ডিমের মতো আকৃতি হওয়ায় এই চরের নাম ডিমেরচর। এ চরটি ভীষণ পছন্দের পর্যটকদের কাছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights