সয়াবিন তেল নিয়ে কী হচ্ছে

রাজধানীর কচুক্ষেত বাজারে শনিবার দুপুরে বোতলজাত সয়াবিন তেল কিনতে যান রাকিবুল হাসান। বাজারে পাঁচটি মুদিদোকান ঘুরে মাত্র একটি দোকানে দুই লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল পান তিনি। তবে সেটিও কিনতে হয়েছে বোতলের গায়ে লেখা দামের চেয়ে ১৫ টাকা বেশিতে। ক্ষোভ প্রকাশ করে রাকিবুল হাসান বলেন, আমার লাগত এক লিটারের সয়াবিন তেলের বোতল। কিন্তু কয়েক দোকান ঘুরেও তা পেলাম না। তাই বাধ্য হয়ে দুই লিটারের বোতলই কিনেছি।

শুধু কচুক্ষেত নয়, রাজধানীর অন্যান্য খুচরা বাজারেও বোতলজাত সয়াবিন তেল মিলছে না বললেই চলে। আর দু-এক দোকানে পাওয়া গেলেও সেগুলোতে গায়ে লেখা দামের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি রাখছেন বিক্রেতারা।

বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের তীব্র সংকট হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ ক্রেতারা। ক্রেতা ধরতে অনেক বিক্রেতা এখন খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি শুরু করেছেন।

শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

খুচরা বিক্রেতা ও তেলের পাইকারি সরবরাহকারীরা বলছেন, মূলত ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজারে কম ছাড়ছেন।

এ বিষয়ে তেল সরবরাহকারী একাধিক কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

খুচরা বিক্রেতারা জানান, বাজারে সয়াবিনের এক, দুই ও পাঁচ লিটারের বোতলের সরবরাহ একেবারেই নেই বললে চলে। পরিবেশকদের কাছে বারবার তাগাদা দিয়েও তেল পাচ্ছেন না তারা। শুধু দু-তিনটি কোম্পানি বোতলজাত সয়াবিন বাজারে ছাড়ছে; যা চাহিদার তুলনায় সামান্য।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, খুচরা পর্যায়ে বর্তমানে এক লিটার খোলা সয়াবিন ১৬৫-১৬৮ টাকা এবং এক লিটার খোলা পাম তেল ১৫৮-১৫৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বোতলজাত সয়াবিন তেলের সাম্প্রতিক সরবরাহ সংকট শুরু হয় সপ্তাহ তিনেক আগে। এরপর সরকার ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক–কর কমায়। এতে প্রতি কেজি ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক-কর ১০ থেকে ১১ টাকা কমেছে। কিন্তু সরকার শুল্ক-কর কমালেও আমদানি বাড়েনি; বরং বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট তৈরি হয়েছে।

এ অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেল পরিশোধন কোম্পানিগুলোকে নিয়ে এক সভা করে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। সভায় ব্যবসায়ীরা জানান, আসন্ন রমজান উপলক্ষে যে পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানি হওয়ার কথা (ঋণপত্র খোলা), তা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন।

গতকালের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।

শুল্ক কমানোর পরও কেন ভোজ্যতেলের দাম কমছে না, সেটি দ্রুততম সময়ে পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে কমিটি।

রমজানকে সামনে রেখে দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা-

সাধারণ ক্রেতারা মনে করছেন, আসন্ন রমজান মাসকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা তেল মজুত করে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি চেষ্টা করছে।

রাজধানীর রায়েরবাজারে সাত থেকে আটটি দোকান ঘুরে দুই লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পেরেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী সাজ্জাদুল আলম। তিনি বলেন, আমার জীবনে এরকম খারাপ পরিস্থিতিতে পড়িনি কখনো। এতগুলো দোকান খুঁজতে হয়েছে। শেষে রাজ্জাক মামার দোকানে পেলাম, তাও দাম বেশি নিয়েছে। কী আর করার আছে, খেতে হলে নিতে তো হবেই। যারা এই সংকট সৃষ্টি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

টি কে গ্রুপের ডিলার মেসার্স শফিক ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী শফিকুজ্জামান লিটন বলেন, বর্তমানে কোম্পানি চাহিদামতো তেল দিতে পারছে না। আগে দুই ট্রাক মাল আসলে, এখন আসছে এক ট্রাক। ফলে, আমরা ঠিকমতো সরবরাহ করতে পারছি না। এখানে আমাদের ভুল বুঝে লাভ নেই। কারণ, আমরা মাল পেলে রেখে দিই না।

মেঘনা গ্রুপের ডিলার শাহনাজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মারুফ হাওলাদার বলেন, কোম্পানি থেকে তেল পাচ্ছি না। দিনে চাহিদা ২০০ কার্টন, সেখানে এখন ১০০ কাটুনও‌ সাপ্লাই পাচ্ছি না। তাহলে, আমরা পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদেরকে কীভাবে দেব?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেল আমদানি হয়েছে ৩ লাখ ৬৮ হাজার টন। গত বছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার টন। সে হিসেবে আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। সয়াবিন তেল তৈরির কাঁচামাল সয়াবিন বীজ আমদানিও খুব বেশি বাড়েনি। এটি সোয়া ২ লাখ টন আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে মাত্র ৯ হাজার টন বেশি।

বিশ্ববাজারে বেড়েছে ভোজ্যতেলের দাম-

শুল্ক-কর কমালেও সয়াবিন তেলের আমদানি না বাড়ার কারণ হিসেবে আমদানিকারকরা বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন।

বিশ্বব্যাংকের পণ্য মূল্য তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিশ্ববাজারে শিগগির ভোজ্যেতেলের দাম কমার সম্ভাবনা কম। তাদের গত ৩ ডিসেম্বর প্রকাশিত পণ্যের মূল্য তালিকা অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে গত এক মাসে পাম ও সয়াবিন তেলের দাম গড়ে টনপ্রতি ৫০ থেকে ৯১ ডলার বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দাম ৫০ ডলার বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৫ ডলার। পাম তেলের দাম ৯১ ডলার বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ১৬৮ ডলার। দুই মাস আগেও পাম তেলের টনপ্রতি দর ছিল ১ হাজার ডলারের নিচে।

বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ৪০ শতাংশ বেড়েছে। সরকার ১০ শতাংশ শুল্ক কমালেও উৎপাদন ব্যয় বেশি। এছাড়া, বর্তমান পরিস্থিতিতে লাভ হওয়ার নিশ্চয়তা না থাকায় ব্যাংকগুলো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে ইতস্তত করছে।

তিনি বলেন, গত ৫ ডিসেম্বর ট্যারিফ কমিশন আমাদের ডেকেছিল। আমরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছি, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে। আমরা এ বিষয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বসব।

আরেক ভোজ্যতেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান টি কে গ্রুপের পরিচালক শফিউল আতহার বলেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েই চলেছে। শুল্ক-কর না কমালে আগেই লিটারপ্রতি ১৩-১৪ টাকা দাম বাড়ত। আবার শুল্ক-কর যা কমেছে, তার চেয়ে বেশি বেড়েছে বিশ্ববাজারে। বেশি দামে কিনলে বাজারে ভালো দাম পাওয়া যাবে কি না, এমন অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় আমদানি কমেছে। সরকার এখন ভোজ্যেতেলের দর যৌক্তিকভাবে সমন্বয় করবে বলে আশ্বস্ত করেছে। তাতে আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ভোজ্যতেলের ঋণপত্র (এলসি) খোলার হার বাড়তে পারে। রোজার আগেই পর্যাপ্ত ভোজ্যতেল আমদানি হবে।

বাধ্য হয়ে অনেকেই দাঁড়াচ্ছেন টিসিবির লাইনে
দোকানে সয়াবিন তেল না পেয়ে অনেকেই ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাক থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে তেল সংগ্রহ করছেন।

রাজধানীর জিগাতলায় টিসিবির ট্রাকের সামনে আগের তুলনায় ক্রেতাদের বেশি ভিড় দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেছেন, বাজারে ১ লিটার ও ২ লিটার তেলের বোতল পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে এখানে দাঁড়িয়েছি।

কাকলি আক্তার নামের এক গৃহিণী বলেন, এখানে আগে এত লম্বা লাইন ছিল না। কয়েকদিন ধরে বেশি মানুষ দেখছি। আমি পরিবারের প্রয়োজনীয় তেল পেঁয়াজ আলু টিসিবির ট্রাক থেকেই নিই। কিন্তু, এখন অনেকে তেলের জন্য এখানে ভিড় করছেন।

বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেছেন, মূল্য সংযোজন কর কমানোসহ নানা সুবিধা দেওয়ার পরও সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো তেলের দাম না কমিয়ে উল্টো সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এখনই ব্যবস্থা না নিলে এবারের রমজানে পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিকর হতে পারে।

হঠাৎ বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজাকে ঘিরে কয়েক বছর ধরে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট একটি পন্থা অবলম্বন করছে। রোজায় দাম না বাড়িয়ে রোজা শুরুর ৩ থেকে ৪ মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখছে। এতে রোজায় ক্রেতারা বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর অতি মুনাফা লুফে নিচ্ছে সেই চিরচেনা সিন্ডিকেট। এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে এদিকে নজর দিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights