মেসির যে ১০ রেকর্ড, যা নেই অন্য কারও

মেসি

জন্মমাস, জন্মশহর—সাযুজ্যের ছায়া যেন বারবারই আভাস দিচ্ছিল, এই ছেলেও একদিন বদলে দেবে ইতিহাস।

রোজারিওর সকালে জন্ম নিয়েছিল যে ছেলেটি,

আজ সে জাদুর ছোঁয়ায় ফুটবল আকাশে সূর্য।

এক পায়ে বিস্ময়, অন্য পায়ে নির্ভরতা,

তার চোখে শুধু গোলপোস্ট নয়, দেখা যায় বিশ্বজয়।

লিওনেল আন্দ্রেস মেসি—নামটা এখন ইতিহাস নয়, স্বয়ং এক ইতিহাস। আজ ২৪ জুন, এই তারিখটিকে পৃথিবীর কোটি ফুটবলভক্ত মনে রাখে ভালোবাসার দিন হিসেবে। ১৯৮৭ সালে আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্ম নিয়েছিলেন মেসি, যেখানে আরও এক বিপ্লবী জন্মেছিলেন—চে গুয়েভারা।

জন্মমাস, জন্মশহর—সাযুজ্যের ছায়া যেন বারবারই আভাস দিচ্ছিল, এই ছেলেও একদিন বদলে দেবে ইতিহাস।

তবে যাত্রা শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। মাত্র ১১ বছর বয়সে ধরা পড়ে গ্রোথ হরমোনের সমস্যা। বাবা-মায়ের পক্ষে সেই ব্যয়বহুল চিকিৎসা সম্ভব ছিল না। সেখানেই খুলে যায় বার্সেলোনা নামের নতুন দুয়ার—যার চৌকাঠ পেরিয়ে ফুটবলের ঈশ্বর রচনা করেন নিজস্ব রাজ্য।

আজ মেসির ৩৮তম জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক এমন ১০টি রেকর্ড যা কেবল তাঁরই নামের পাশে মানায়। এই রেকর্ডগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, মেসির ইতিহাসের স্তম্ভ।

প্রথমেই আসে সেই রেকর্ড, যা প্রতিটি ফুটবলারের স্বপ্ন—ব্যালন ডি’অর। ৮ বার এই পুরস্কার জিতেছেন মেসি। বিশ্বের আর কোনো খেলোয়াড় এতবার এই সম্মান পাননি। তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রোনালদো আছেন ৫টি নিয়ে।

আরও অবিশ্বাস্য এক অর্জন তাঁর—২০১২ সালের ক্যালেন্ডার বছরে করা ৯১ গোল। ভাবুন তো, একটি বছর পেরোতেই না পেরোতেই একজন খেলোয়াড় একাই ৯১ বার বল পাঠিয়েছেন প্রতিপক্ষের জালে! এর মধ্যে ৭৯টি গোল বার্সেলোনার হয়ে, বাকি ১২টি আর্জেন্টিনার জার্সিতে।

একইভাবে, একই ক্লাবের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ডও শুধুই মেসির। বার্সেলোনার হয়ে করেছেন ৬৭২টি গোল—এতটা দীর্ঘ সময় ধরে এক ক্লাবের প্রতি ভালোবাসা এবং এত ধারাবাহিকতা ফুটবলে বিরল। শুধু গোল নয়, তিনি বার্সার হয়ে খেলেছেন সর্বোচ্চ ৭৭৮টি ম্যাচও।

চ্যাম্পিয়নস লিগেও তাঁর রাজত্ব সমানতালে চলেছে। বার্সেলোনার হয়েই এই ইউরোপীয় মঞ্চে করেছেন ১২০ গোল—একই ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড এটি। একই সঙ্গে, তিনিই প্রথম খেলোয়াড়, যিনি এই টুর্নামেন্টে একটি ম্যাচে ৫ গোল করার কীর্তি গড়েছেন—২০১২ সালে বেয়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে।

বিশ্বকাপ—যার স্বপ্নে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ফুটবলার বাঁচেন, সেখানেও মেসির উপস্থিতি কিংবদন্তির মতো। তিনি খেলেছেন ২৬টি ম্যাচ, যা বিশ্বকাপ ইতিহাসে সর্বোচ্চ। গোল করেছেন ১৩টি, সহায়তা করেছেন আরও ৮টিতে—সব মিলিয়ে ২১টি গোল অবদান। ১৯৬৬ সালের পর থেকে যে পরিসংখ্যান রাখা হচ্ছে, সেখানে তিনিই শীর্ষে।

বিশ্বকাপের আরও একটি রেকর্ড তাঁকে আলাদা করে দেয়। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব, রাউন্ড অব সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল এবং ফাইনাল—সব পর্যায়েই গোল করেছেন। প্রতিটি পর্বে তাঁর উপস্থিতি ছিল কার্যকর।

বিশ্বকাপের ইতিহাসে মেসি একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি পাঁচটি ভিন্ন আসরে অ্যাসিস্ট দিয়েছেন। আর সবশেষ কাতার বিশ্বকাপে, ৩৬ বছর বয়সেও গোল্ডেন বল জিতে প্রমাণ করেছেন, বয়স তাঁর থেমে যাওয়ার কারণ নয়—বরং নতুন করে জ্বলে ওঠার উপলক্ষ।

জাতীয় দলের হয়ে দক্ষিণ আমেরিকান খেলোয়াড়দের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১২ গোল তাঁর। বিশ্ব পর্যায়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবে আছেন তিনি, রোনালদোর পরেই। তবে রেকর্ড শুধু সংখ্যায় নয়—মেসির গড়ে দেওয়া প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক একটি ইতিহাস।

সবশেষে, এমন একটি রেকর্ড যা একমাত্র ‘‘রাজা’’দেরই মানায়—সবচেয়ে বেশি ট্রফি জয়। ক্লাব, দেশ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে মিলিয়ে মেসির শোকেসে এখন রয়েছে ৪৬টি শিরোপা।

মেসি শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি একজন নীরব বিপ্লবী। মাঠে শব্দহীন ঝড় তোলা একজন কবি। জন্মশহর রোজারিও তাকে জন্ম দিয়েছিল এক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে, আর বিশ্ব তাকে চিনেছে এক সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে। ৩৮ বছরে পা রাখা এই মানুষটি আসলে কোনো বয়সে বাঁধা পড়েননি। কারণ মেসি মানে সময়কে পরাজিত করা এক ধ্রুপদী নাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Verified by MonsterInsights